মারা গেলেন নব্বই দশকের জনপ্রিয় ব্যান্ড চাইমের ভোকাল খালিদ। মাত্র ৫৮ বছর বয়সী এই গায়কের প্রয়াণে মাতম করছে সামাজিক মাধ্যম। শোকে মুহ্যমান মানুষেরা স্মৃতিমেদুর হয়ে স্মরণ করছেন নব্বইয়ের দশক।
কেবল খালিদ নন, আমরা দেখতে পাই, নব্বই দশক মাতানো যে কোন শিল্পী, তা সে অভিনয়শিল্পী হোন বা সংগীতশিল্পী, দেশি কিংবা বিদেশি, মারা গেলে গোটা সামাজিক মাধ্যম জুড়ে নস্টালজিয়া ছড়িয়ে পড়ে। এর কারণ কি?
প্রাচীন গ্রিক ভাষায় নস্তোস শব্দের অর্থ বাড়ি ফেরা, আর আলগোস মানে বেদনা। এই দুই শব্দ মিলে ল্যাটিন ভাষায় নস্টালজিয়া শব্দটির জন্ম। ইংরেজিতে নস্টালজিয়া শব্দের মানে অতীতের কোন ঘটনা নিয়ে তীব্র আবেগ, যেন একজন বাড়ি ফেরার জন্য তড় পাচ্ছে।
নব্বই দশক নিয়ে এই তড়পানিটার কারণ কি? একটা বড় কারণ সম্ভবত, যেই মানুষগুলো নব্বই দশকে কিশোর বা তরুণ ছিলেন, তাঁরা এখন পরিণত বয়সী। এই বয়সী মানুষগুলো সামাজিক মাধ্যমগুলোতে সক্রিয় এবং বেশ প্রভাব বিস্তার করে থাকেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এই বয়সী মানুষগুলোই সামাজিকমাধ্যমে প্রথম প্রজন্ম। প্রথমবারের মতো এইরকম একটা গণ প্ল্যাটফর্মে নস্টালজিক হয়ে পড়াটা প্রকটভাবে চোখে পড়ে। আবার সেসময়ের তারকাদের বয়স এখন হরেদরে ষাট থেকে আশির মতো। কেউ কেউ পুরোপুরি হারিয়েও যাননি। হয়তো নিজের মাধ্যমে বিগতযৌবন হয়ে টিকে আছেন। ফলত, এই মানুষগুলো মারা গেলে সংবাদমাধ্যমেও দ্রুত খবর চলে আসে।
কিন্তু, ৯০ নিয়ে স্মৃতিকাতরতা কি কেবল এই কারণ গুলোতেই? এক দশক পরে শূন্য দশক নিয়ে বা দুই দশক পরে কি প্রথম দশক নিয়ে এতটা নস্টালজিয়া থাকবে। থাকার সম্ভাবনা কম। কেননা নব্বইয়ের দশকের স্মৃতিমেদুরতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে সমাজের রূপান্তর, স্বপ্ন, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ বেশ কিছু বিষয়। পশ্চিমে যে ‘ভাইব্রেন্ট সিক্সটিজ’ বলা হয় আমাদের প্রেক্ষাপটে আশি আর নব্বই দশক ছিল সেই উত্তাল সময়। তারুণ্য আর রোমান্টিসিজমের।
সামাজিকভাবে ৯০ ছিল সামষ্টিকতার সময়। লোকে মাঠে গিয়ে ফুটবল খেলতো, হলে গিয়ে সিনেমা দেখত, লাইব্রেরিতে গিয়ে বই পড়ত। শ্রমিক শ্রেণির মানুষেরা ট্রেড ইউনিয়ন করতেন। ক্লাব ছিল ছেলে বুড়োদের মিলনমেলা আর পাড়া কালচার ছিল শহরের প্রাণ।
যেই শিল্পীদের প্রয়াণে আমরা স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়ছি, তাঁদের একটা সর্বজনীন আবেদন ছিল। এদের একেকটা ক্যাসেট বের হলে আমরা আগ্রহ নিয়ে বারংবার শুনতাম, কারণ সেসময় কনটেন্ট ছিল সীমিত। আর তখনো এলগরিদম আমাদের গ্রাস করেনি। আমরা কোন গান শুনবো, কোন সিনেমা দেখব তা যন্ত্র ঠিক করে দিত না। রুচি, বয়স, শ্রেণি অনুসারে ভাগ হয়ে যেতো না। ভালো লাগুক আর নাই লাগুক একত্রে শোনা হতো গান, দেখা হতো সিনেমা, ফুটবল।
ফলত, যখন সেই সব ব্যাপারগুলো মনে পড়ে, সেই সময়ের মানুষগুলো সহজেই একটা যৌথ অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে পারেন। এই গ্ণ নস্টালজিয়া অনূদিত হয় দ্বীপের মতো বিচ্ছিন্ন একেকটা মানুষের সামাজিক মাধ্যমে।
বিজ্ঞানীরা বলেন, সৃষ্টিশীল হতে হলে ‘বোরড’ হয়ে পড়া খুব জরুরি। কিন্তু, এখনকার দিনে বোরড হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ অগণিত কনটেন্ট তৈরি হচ্ছে, একটা মুহূর্ত থামার উপায় নেই। এখনকার দিনের তরুণেরা তো দ্বিগুণ স্পিডে চালিয়েও সিনেমা দেখে, বই পুরোটা পড়ার বদলে নির্যাসটুকু জানার অ্যাপ আছে।
এই অগণিত কনটেন্ট আমাদের মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে আর আমাদের বিনোদন, আনন্দ বা দুঃখ ভাগাভাগি করার বিষয়টা হয়ে পড়েছে একান্ত ব্যক্তিগত। আইরনি হচ্ছে, সবচেয়ে বেশি নিঃসঙ্গ মানূষেরাই সবচেয়ে বেশি সময় কাটাচ্ছেন ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমগুলোতে।
সেই ভাইব্রেন্ট সিক্সটিজে হার্বাট মার্কুইসে বলেছিলেন ওয়ান ডাইমেনশন মানুষদের কথা। টেলিভিশনের প্রভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া, চেষ্টাশূন্য অবস্থায় স্ক্রিনের দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকা মানুষদের কথা। আমাদের বেলায় ব্যাপারটা ফলতে শুরু করল নব্বইয়ের পর থেকে। আর যদ্দিনে কম্পিউটার-ইন্টারনেট রমরমা হলো, তদ্দিনে বিশ্বায়নের ঢেউ এসে লাগল। স্থানিক সম্প্রদায়ের বদলে আমরা ক্রমশ গড়ে তুলেছি বৈশ্বিক সম্প্রদায়। বাসার যুবক ছেলেটি যদি প্রিয় ফুটবল ক্লাবের বৈশ্বিক সমর্থকদের সঙ্গে সারা দিন সখ্য গড়ে তোলে তো, বাড়ির মেয়েটি হয়তো বিটিএস আর্মির সক্রিয় সৈনিক। আর বাড়ির মুরুব্বি ইউটিউবে কিংবা টেলিভিশনে সময় কাটাচ্ছেন ধর্মীয় ভাষণ বা পুরোনো দিনের সিনেমা দেখে।
যাযাবর সেই কবে বলেছিলেন, বিজ্ঞান আমাদের কেড়ে নিয়েছে আবেগ। কিন্তু, তিনিও হয়তো ভাবতে পারেননি প্রযুক্তি, বিশ্বায়ন আর নব উদারতাবাদের কঞ্জুমারিজম আমাদের সামষ্টিক স্মৃতি আর আবেগগুলো পর্যন্ত বিলীন করে দিতে পারে।
নব্বইয়ের সামষ্টিক আবেগ কেবল বিনোদনেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সদ্য তরুণ হয়ে ওঠা দেশটি তখন স্বপ্নে বিভোর। গণমানুষ একত্র হয়ে স্বৈরাচারের পতন ঘটানো যায় সেই বিশ্বাসে গর্বিত জনতা, লাখো মানুষের প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া দেশটা নিয়ে তখন এক তারুণ্যদীপ্ত স্বপ্ন।
গ্রাম থেকে শহরে আসছে উদ্দীপ্ত তরুণেরা। শিক্ষা নামক জাদুর মই বেয়ে সামাজিক উল্লম্ফনের স্বপ্ন। একটা চাকরি, পরিবারের সঙ্গে সপ্তাহান্তে সময় কাটানো, নির্মল আনন্দ, আর সারা জীবন কাজের পর সঞ্চিত অর্থ দিয়ে একফালি জমি কিংবা একটা ছোট বাড়ি। মধ্যবিত্ত তখন দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি আর সামাজিক শকটের চালকের আসনে।
কিন্তু, সেই স্বপ্ন পূরণ হলো না। গণতন্ত্র নামকাওয়াস্তে আসল ঠিকই, কিন্তু মুক্তবাজার অর্থনীতির ধাক্কায় বাড়ল অসাম্য। চাকরি করে বাড়ি গাড়ি করার ব্যাপারটা বাস্তবে সম্ভব হলো না। শিক্ষার বদলে দলীয় রাজনীতি, দুর্নীতি হয়ে উঠল উন্নয়নের সোপান। মধ্যবিত্ত রাশ হারাল, সমাজ থেকে হারায়ে গেল মধ্যবিত্ত আবেগ আর নীতিবোধ। যার কেন্দ্রে ছিল সামষ্টিকতা। এর বদলে আসল যে কোন প্রকারে অর্থ উপার্জনের মরণ দৌড়ের প্রতিযোগিতা। মধ্যবিত্তের নীতিবোধের শাসন না থাকায়, এ প্রতিযোগিতা পরিণত হলো রীতিমতো বেলোল্লাপানায়।
নব্বইয়ে অবশ্য মুরব্বিরা লম্বা চুল আর ব্যান্ডের গান গাওয়াকেই বেলেল্লাপনা ভাবতেন। কিন্তু সেই উত্তাল সময়ে লম্বা চুলের বাকের ভাইরা ছিলেন দ্রোহের প্রতীক, আর গিটার বাজিয়ে, নতুন ধরনের গান গেয়ে নিজেদের সৃষ্টিশীলতাকে খোঁজা খালিদরা হয়ে উঠলেন তারুণ্য উচ্ছল সময়ের আইকন। খালিদরা তখন স্বপ্নে বিভোর একটা প্রজন্মকে উদ্বেল করছেন। বাংলাদেশের তরুণেরা তখন স্বপ্ন দেখছে গানে, কবিতায়, অভিনয়ে আর জীবনবোধে পুরোনো অচলায়তন ভেঙে ফেলার। পুরোনোরা নাক সিটকাচ্ছেন, সব উচ্ছন্নে গেল বলে, পশ্চিমের অন্ধ অনুকরণ বলে হাহুতাশ আর ব্যঙ্গ করছেন। কিন্তু, তখন খালিদরা সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপছেন। ওসব কথা পাত্তা দেওয়ার সুযোগ কই!
সেই থরোথরো আবেগটা সামাজিক মাধ্যমে তিন যুগ পরে ফিরে ফিরে আসে নিজেদের হারিয়ে ফেলা, হেরে যাওয়া,বিচ্ছিন্ন মানুষগুলোর কাছে। সোনালি সময়ে, ভেঙে যাওয়া স্বপ্নটা ছুতে হাহাকার বেজে উঠে মাঝদরিয়ার হারানো জাহাজের বুক থেকে আসা শো শো শব্দের মতো।
সেই সরল, প্রাণবন্ত সময়ের বদলে কঞ্জুমারিজমের বিপুল চাপে এখন প্রতিটা মুহূর্তের হিসাব করার যন্ত্রগণকে পরিণত হয়েছে সেই মানুষগুলো। সময়ই টাকা, এক মুহূর্ত ‘নষ্ট’ করা মানে জীবনযুদ্ধে পিছিয়ে পড়া। এই সোমরসে মত্ত থাকারা ভুলে যায়, এই যুদ্ধ আসলে টলস্টয়ের সাড়ে তিন হাত জমির নায়কের আত্মঘাতী দৌড়ের মতো, রাজা সিসিফাসের নিরন্তর গড়ানো পাথরের মতো অভিশপ্ত।
ফলত, তাঁর বিনোদনও সময়ের নিগড়ে বাঁধা। শুধু কি তাই? নিজের সত্তাকে মুক্ত না করে সে ক্রমশ হয়ে উঠতে চায় পলিটিক্যাল কারেক্টনেসের রসকষহীন লোকদেখানো যন্ত্রে। এমনকি ধর্মপালনের মতো আত্মিক বিষয় হয়ে পড়ে প্রতি মুহূর্তে স্কোর করার মতো। সবকিছুতে ‘সহি’ খোঁজার চাপ পিষ্ট মানুষগুলো ভুলে যায় নিজের আসল, উচ্ছল চেহারাটা।
খালিদের মৃত্যু যেন হুট করে সেই আয়নাটা সামনে নিয়ে আসে। কিন্তু, এই আয়না যেন অর্ফিয়াসের আয়ানার মতো অভিশপ্ত। সুখস্মৃতির ছবির সঙ্গে ভেসে আসে হাহাকারের আবহ সংগীত।
নব্বইয়ের দশক আমাদের জন্য শেষবারের মতো চমকেরও। নতুন প্রযুক্তির ঢলে আমরা শিশুর মতো বিস্মিত হতাম। ভোট দিতে পারার, নিজেদের দেশটা নিজেদের মতো করে নেওয়ার আনন্দে বিভোর হতাম। কিন্তু, প্রযুক্তির সেই চমক এখন আর সেইরকম বিস্ময় হয়ে আসে না। সেই যুগে এমনকি শহুরে মানুষেরাও আলোকসজ্জা আর কম্পিউটার গেমসকে উপভোগ করত অপার বিস্ময়ে। এখন সেই বোধটা কেটে গেছে। প্রযুক্তির উৎকর্ষ স্বাভাবিক হয়ে গেছে। শুধু তাই না, প্রযুক্তি যে ক্ষেত্রবিশেষে দানব, আমাদের দাস বানিয়ে রাখে, আমাদের সদা পাহারায় রাখে, সারভেইলেন্স ক্যাপিটালিজমের সেই ক্লান্তিকর অসহায় বোধটাও পরিশ্রান্ত করে দেয়। তাই নব্বইয়ের স্মৃতি প্রায় হারানো সেই বিস্ময়ের রেণুগুলো যেন বয়ে নিয়ে আসে সুবহে সাদিকের পবিত্র বাতাসের মতো।
খালিদের মৃত্যু তাই আমাদের এক অনির্বচনীয় অনুভূতি দেয়। কার্ল মার্ক্স এলিয়েনেশন তত্ত্ব দিয়ে বলেছিলেন, পুঁজির দাপটে মানুষের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হচ্ছে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এই বিজ্ঞ জার্মান দার্শনিকও হয়তো আমাদের প্রবল বিচ্ছিন্নতা দেখে শিউরে উঠতেন।
এই বিচ্ছিন্ন মানুষগুলোর বেদনাবিধুর স্মৃতিমেদুরতা এক দুঃখভরা গল্প।
লিখেছেন: সৈয়দ ফায়েজ আহমেদ
অন্যান্য মুভি ডাউনলোড ও ব্লগের জন্য ভিজিট করুনঃ Blog