‘রেহানা মরিয়ম নূর’
আমি ভাবছিলাম, লেখাটি শুরু করবো ঠিক কোন জায়গা থেকে। এই সিনেমার শুরু নেই। এই সিনেমার শেষ নেই। এই সিনেমায় যতগুলো প্রশ্ন করা হয়েছে, তার কোনো উত্তর নেই। এই সিনেমার দৃশ্যগুলো কাটা কাটা। পরিপূর্ণ কোনো দৃশ্য নেই। এই সিনেমার চিৎকারগুলোও গিলে ফেলা, অর্ধেক আছে, অর্ধেক নেই। যেমন ধরুন, ওয়াশরুমের এই দৃশ্যটা। যেখানে একজন ছাত্রী বমি করছে। পাশে দাঁড়িয়ে আছেন একজন নারী। উনার নাম, রেহানা মরিয়ম নূর। ছাত্রীর নাম, অ্যানি।
অ্যানি কিছুক্ষণ আগে ড. আরেফিন নামক একজন শিক্ষকের রুম থেকে উদভ্রান্ত বিধ্বস্ত চেহারায় বের হয়ে এসেছে। কান্না বমি দু’টোই আটকে ছিল গলায় তখন, জামার উপরের বোতামটা ছিল ছেঁড়া। বমি করার পর রেহানার কাছে অ্যানি প্রথম চাইলো একটা সেইফটি পিন।
‘আপনার কাছে কী একটা সেইফটি পিন হবে?’
ছেঁড়া বোতামের জায়গায় সেইফটি পিন আটকানোর পর সদ্য সেক্সুয়ালি হ্যারাজড হওয়া অ্যানি ফোন কানে লাগিয়ে মাকে জানালো, সে ভালো আছে। সামান্য ঠাণ্ডা লেগেছে তার। কম্বল বের করা হয়েছে, টেনশনের কিছু নাই। কি ভয়ংকর রিলেটেবল একেকটা দৃশ্য। আমাদের দেশের মেয়েদের রোজকার যাপন করা এক জীবন যেন। অ্যানিকে অনায়াসে আমাদের দেশের আর দশজন মেয়ের কাতারে ফেলে দেওয়া যায়। যারা, শুধুমাত্র নিজের চরিত্রের দিকে ‘প্রশ্ন’ উঠবে বলে ভয়ংকর সব স্মৃতি শরীর কিংবা পেটের ভেতর থেকে বমি করে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করে।
এই সিনেমার গল্প এটাই। দশজন বমি করে বের করে দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টায় রত, একজন সবকিছুর বিপরীত দিকে অবস্থান নিয়ে সমস্ত কিছু ফের মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় রত। গল্প নিয়ে আমি কিছু বলবো না। এটা আদৌ কোনো রিভিউও হবে কিনা আমি জানি না। কারণ, গল্প, স্ক্রিনপ্লে, পরিচালনা, বিজিএম, কালার, ক্যামেরার কাজ সব বাদ দিয়ে আমি শুধু রেহানা মরিয়ম নূর চরিত্রটাকে স্তরে স্তরে বর্ণনা করবো। আমার দেখা যেকোনো বাংলা সিনেমার সবচেয়ে শক্তিশালী চরিত্র এটি।
একটা তথ্য। প্রথম দৃশ্য থেকে শেষ দৃশ্য অবধি এই সিনেমায় ‘দরজা’ একটা দারুণ মেটাফোর হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। বারংবার।
‘স্পয়লার অ্যালার্ট’
পরীক্ষা চলছে। রেহানা লক্ষ্য করলেন একটা স্কেল পড়ে আছে নিচে। স্কেলটা যে ছাত্রীর কাছাকাছি পড়ে আছে, ঐ ছাত্রীকে এর আগেও সন্দেহজনক আচরণের জন্য চেক করেছেন তিনি। ফের স্কেল পড়ে থাকতে দেখে, স্কেল হাতে নিয়ে চেক করেন। নকল পান। নকল করার জন্য ঐ ছাত্রীকে তখনই বের করে দেন হল থেকে। ড. আরেফিন যখন এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে রেহানার রুমে যান, এবং বলেন, ‘স্কেলের মধ্যে দুয়েকটা পয়েন্ট লিখে আনাকে নকল বলে না, এটা লাইফে সবাই করে।’ রেহানা বলেন, ‘না। সবাই করে না।’
আমাদের মধ্যে যেকোনো একটা অপরাধকে সামান্য হালকা করে ফেলার জন্য ‘এটা অনেকেই করে’ বাক্য ব্যবহার করা হয়। রেহানা তা করেন না। ফলে রেহানা দরজার ওপাশে আটকা পড়লেন।
অ্যানির সঙ্গে পরে দেখা করলেন রেহানা। অ্যানি পুরো বিষয়টা ভুলে যেতে চাইলো। যেখানে রেহানার ধারণা ছিল, অ্যানি কিছু একটা অন্তত করার ক্ষমতা রাখে। সে একা নয়। তার বন্ধু আছে, সঙ্গে রেহানা নিজেও আছেন। অথচ অ্যানি জানালো, গতকাল কিছু হয়নি। সে ভালো আছে। সব চুপচাপ। শেষ।
ড. আরেফিনের রুমের বাইরে অন্য একজন ছাত্রীকে নক করতে দেখে রেহানা নিজের রুমে এসে অস্থির হয়ে উঠলেন। কারণ, আরেফিনকে তিনি জানেন। অ্যানির সঙ্গে যেটা হয়েছে, সেটা অন্য কারোর সঙ্গে হবে না, তার কী গ্যারান্টি? রেহানা ছুটলেন আরেফিনের দরজায়। জোর করে ভেতরে ঢুকে পরীক্ষা করলেন, কেউ আছে কিনা।
যেখানে ভিক্টিম নিজেই ঘটনা ভুলে যাওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করছে, আর দশজন এই জায়গায় ভিক্টিমের অন্দরমহলে ঢোকার চেষ্টা না করেই ঘটনা ভুলে যেতো। কারণ, ঘটনা তাদের সঙ্গে ঘটেনি। রেহানার সঙ্গে কিছু ঘটেনি, তাও রেহানা ভুলেননি। দ্বিতীয়বার রেহানা দরজার ওপাশে আটকালেন।.
রেহানা অ্যানির সঙ্গে আবার দেখা করেন। বোঝানোর চেষ্টা করেন, এই ঘটনা নিয়ে আজ যদি চুপ থাকে সে, তবে ঐ লোক আরও অনেকের সঙ্গে একই কাজ করবে। অ্যানি রাজি হয় না। কারণ, ক্লাস ছুটির পর স্যারের রুমে সে গিয়েছিল নিজে। নারীদের সাধারণত নির্দিষ্ট সময় বাদে অন্য কোনো সময় কারোর বাসা, পার্ক, রাস্তা, রিসোর্ট কিংবা অফিসেও যাওয়া যায় না। হোক তা যতই জরুরি কাজ। যাওয়া যাবে না। যাওয়া মানেই সেক্স করার অটোম্যাটিক পারমিশন। অফিস টাইম বাদে কারোর অফিসে ঢোকা মানেই ‘আসো, আমায় নিয়ে শুয়ে পড়ো’। অ্যানি রাজি হয় না। রেহানাকে অ্যানি হুমকিও দেয়, যদি রেহানা এই বিষয় নিয়ে প্রিন্সিপালকে কোনো কমপ্লেন করতে যায়, তবে সে ছাদ থেকে লাফ দেবে। তার কিছুক্ষণ পর রেহানা ড. আরেফিনকে বলেন, ‘আমি দেখতে পাচ্ছি কয়েকদিন ধরে আপনি আমাকে তুমি করে বলছেন। কিন্তু তুমি করে বলার আগে আমার পারমিশন নেন নাই।’
বাঙালিদের ‘কনসেন্ট’ ‘পারমিশন’ ‘অনুমতি’ এইসব শব্দ সকালের চায়ের সঙ্গে গুলে খাইয়ে দিলেও বুঝতে পারবে না। রেহানা আরেফিনকে অপছন্দ করছে। অপছন্দ আমরা অনেক মানুষকেই করি। কাউকে জানাই, কাউকে জানাই না। রেহানা আরেফিনকে ঘৃণা করে, অ্যানির ঘটনাকে কেন্দ্র করেই যে ঘৃণার সূত্রপাত। অন্য কেউ হলে করতো না। স্বামী অপরাধী জেনেও সিনেমার মাঝখান দিকে আরেফিনের স্ত্রী আয়েশা বলেছিল, ‘সবাই জেনে গেলে আমি কী করে থাকবো ওর সঙ্গে?’ অথচ, স্বামী অপরাধী জেনেও আয়েশা এতদিন ধরে থেকেছে আরেফিনের সঙ্গে। অন্য আর দশজন যেখানে রাখতো, রেহানা প্রকাশ্যে ঘৃণা করছে আরেফিনকে, এবং তা প্রকাশ করায় রাখঢাক রাখেনি। ফলে রেহানা তৃতীয়বার দরজার ওপাশে আটকালেন।
রেহানা আরেফিনকে ধমক দেয়, যদি সে কনফেস না করে তার অপরাধ, তবে প্রিন্সিপালের কাছে কমপ্লেন করবে। নয়তো তার স্ত্রী আয়েশাকে জানাবে। আরেফিন সবকিছু অস্বীকার করে। রেহানা গিয়ে আয়েশাকে সব জানিয়ে দেয়। এই কাজগুলো রেহানা কেন করছে? এই প্রশ্নটা অ্যানি নিজেও করে এক পর্যায়ে। আপনার সঙ্গে তো কিছু হয় নাই? কেন আপনি এইরকম করতেছেন?
নিজের সঙ্গে ঘটা অবধি মানুষ কোনোকিছু নিয়ে প্রতিবাদ করে না। অনেক মানুষ প্রতিবাদ করে ভিক্টিমের জায়গায় নিজের পরিবারের কোনো আপনজনকে বসিয়ে, ঐ ক্ষোভ থেকে। অনেককে বলতে শুনবেন, ‘একবার ওর জায়গায় নিজের বোনকে ভেবে দেখ।’ নিজের মা, নিজের ভাই, নিজের বোন, নিজের অমুক ভেবে ভেবে করা প্রতিবাদগুলো প্রতিবাদ হয় বটে, কিন্তু কেমন যেন। কেন ঐ জায়গায় একটা মানুষ ভেবে প্রতিবাদ করা যায় না? নিজের ভাই বোন স্ত্রী স্বামীকে বসিয়েই কেন এই প্রতিবাদ করতে হবে?
রেহানার তো কেউ হয় না অ্যানি সম্পর্কে। যেখানে অ্যানি নিজেই হুমকি ধমকি দিচ্ছে যদি এই ঘটনা জানাজানি হয়, সে সুইসাইড করবে, সেখানে রেহানার এই জেদ কেন? ঐ যে প্রথম দৃশ্যটার কথা মনে আছে? ‘এইরকম ভুল লাইফে সবাই করে দুয়েকবার।’ রেহানা বলেছিল, সবাই করে না। রেহানা আরও একবার আটকালেন দরজার ওপাশে।
রেহানা আয়েশাকে জানিয়ে শান্ত হয় না, প্রিন্সিপালকেও কমপ্লেন করে। তবে অ্যানিকে কেন্দ্রে রেখে নয়। এইবার কেন্দ্র সে নিজে। রেহানা কমপ্লেন করে, আরেফিন তাকেই সেক্সুয়ালি হ্যারাজ করার চেষ্টা করেছে। কলেজের রেপুটেশনের দিকে তাকিয়ে প্রিন্সিপাল নিজেও কৌশলে বোঝানোর চেষ্টা করেন, কত বড়ো একটা রিস্ক নিতে যাচ্ছে রেহানা নিজে। রেহানা অটল।আরেফিন যখন জানতে পারে কমপ্লেন করা হয়েছে, সে রেহানাকে কমপ্লেন তুলে নিতে বলে। অনুরোধ করে। শেষে ধমকও দেয়। রেহানা জিজ্ঞেস করে, ‘কমপ্লেন না তুললে কী করবেন? আমাকেও রেপ করবেন?’ আরেফিন তখন একটা কথা বলেন, ‘সব মেয়েরা রেপড হয় না। সত্যি বলতে কি জানো? তোমার মতো মেয়েরাই রেপড হয়।’ খেয়াল করুন। মেডিকেল কলেজের একজন শিক্ষক বলছেন এই কথা। এবং তিনি সেটা বিশ্বাস করেন। ধর্ষণ বিষয়ক একটা লেখায় অনেক আগে লিখেছিলাম আমি, আমাদের গোড়ায় সমস্যা। যে মাটি হতে বীজ অঙ্কুরিত হয়ে বৃক্ষ হওয়ার কথা, বীজে নয়, ওখানকার মাটিতেই মূল সমস্যা। মেয়ে জেদী হলে, মেয়ে অহংকারী হলে, মেয়ে শক্ত হলে, মেয়ে প্রতিবাদী হলেই তাকে রেপড হতে হবে, তাকে রেপ করা যায়, এই সমস্ত তথ্য খুব কৌশলে বাঙালিদের মাথায় ঢুকিয়েছে একপাল শুয়োরের বংশধর।পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি রেহানা। আর কেউ নেই। এই কমপ্লেনের ফলে তার আর্থিক সংকট বাড়তে পারে, নানানদিকে সমস্যা হতে পারে, এতকিছু জানার পরও সে কমপ্লেনটা করে। অন্য আর দশজন হলে যেটা ভুলেও করার চিন্তা করতো না। রেহানা ফের একবার দরজার ওপাশে আটকালেন।
রেহানার মেয়ের নাম ইমু। মায়ের জেদ, কাঠিন্য, প্রতিবাদী আর কাটা কাটা স্বভাব মেয়েকে প্রভাবিত করবে, সেটাই স্বাভাবিক। ছোট্ট একটা ভিজুয়াল উদাহারণ দিতে পারি। মেয়েকে অফিসে রেখে বাইরে গেছেন রেহানা। মেয়েকে বলে গেছেন, অফিস থেকে বাইরে বের না হতে। মেয়ে বাইরে বের হয়ে গেছে তাও। মেয়েকে খুঁজে এনে বকাঝকা করলেন রেহানা। তারপর বললেন, দশবার কান ধরে উঠবোস করো। ছোট্ট এইটুকুন মেয়ে। কতই বা আর বয়স। এই বয়সী বাচ্চারা তো একটা চকোলেটের জন্যও কান ধরে দশবার উঠবোস করে। অথচ এই মেয়ে চট করে কান ধরেনি। পুরো বিশ সেকেন্ড সময় নিয়েছে। এরমধ্যে দুইবার মাকে পুনরায় একই ধমক দিতে হয়েছে। কানের কাছে গিয়েও একবার থেমে গিয়ে ইতস্তত করা ছোট্ট ঐ হাতটুকুন আমায় মুগ্ধ করেছে। কি প্রবল আত্মসন্মানবোধ।
ইমু কামড় দিয়েছে এক সহপাঠিকে। কারণ সহপাঠি ইমুকে চিমটি কাটতো। রেহানাকে ডাকা হয়েছে স্কুলে। টেবিলের একপাশে রেহানা বসে। এই দৃশ্যটি আমার এতবেশী পছন্দ। রেহানাকে বলা হচ্ছে, এই বয়সে আপনার মেয়ে এত ভায়োলেন্ট, বড়ো হয়ে কী হবে? রেহানা পাল্টা জিজ্ঞেস করতেছে, এই বয়সে আপনার ছেলে এত এবিউসিভ, বড়ো হয়ে কী হবে?এই দৃশ্যে সম্ভবত সহপাঠির মা রেহানাকে একটা ফ্রি উপদেশ দেন। মেয়েদের এত ইগো ভালো না। রিলেটেবল?
এইবার সিনেমার ক্লাইম্যাক্সের দিকে আসা যাক। প্রথমদিকের স্কেল আর ছাত্রী। যাকে হল থেকে বের করে দিয়েছিল রেহানা। আরেফিন ও প্রিন্সিপাল মিলে এই ছাত্রীকে কাজে লাগালেন। যেহেতু রেহানা আরেফিনের বিরুদ্ধে করা কমপ্লেনটা তুলবে না। ঐ ছাত্রীকে উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়াই হল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে, এইরকম একটা তথ্য সামনে রেখে সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীর উপর পুরো বিষয়টার সত্যতা প্রমাণ করার ডিসিশন নেওয়া হলো। রেহানাকে অপছন্দ করে অমন ছাত্র-ছাত্রীই বেশী। আমরাও আমাদের সবচেয়ে কর্মঠ ও দায়িত্বশীল শিক্ষককে অপছন্দ করতাম স্কুল কলেজে। কারণ তিনি পরীক্ষায় দেখে দেখে লিখতে দিতেন না, পড়ার সময় পড়া, গল্পগুজব নয় ইত্যাদি বিষয়ে সচেতন ছিলেন। রেহানা উপযুক্ত কোনো প্রমাণ ছাড়াই ঐ ছাত্রীকে বের করে দিয়েছেন হল থেকে, এই তথ্যের পক্ষে সমস্ত ছাত্র-ছাত্রী হাত তুলল। কারোর হাতের তোয়াক্কা রেহানা করেন না। কিন্তু একটা হাত ওখানে অ্যানির। একে তো একটা সেক্সুয়াল হ্যারাজমেন্ট কেইসের জন্য হাত তুলেনি এই মেয়ে, উপরন্তু ঐ ছাত্রীর নকল করার ঘটনায় প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে অ্যানির নিজেরও, এতকিছুর পরও অ্যানির উপরে তোলা হাতটা আঘাত করল রেহানাকে। রেহানা পাল্টা আঘাত করলেন। থাপ্পড় বসালেন অ্যানির গালে।এই থাপ্পড়টাই ক্লাইম্যাক্স।মিমি হেরে গিয়েছিল। এবং রেহানা এইবার ভিজুয়ালি আটকালেন দরজার ওপাশে।
ছাত্র-ছাত্রীরা গেইট বন্ধ করে দিলো। একজন ছাত্রীর গায়ে হাত, এত বড়ো সাহস! তারা রেহানার রিজাইন চাইলো। নয়তো গেইট খোলা হবে না। রেহানার যে ভাই রোজ ইমুকে স্কুল থেকে নিয়ে আসে, সে চাকুরির ইন্টারভিউতে আটকে গেল। মেয়েটা একা বসে আছে স্কুলে। রেহানার স্কুলে যাওয়া প্রয়োজন। অথচ গেইট বন্ধ। রেহানা ছুটে যায় গেইটে। এই দৃশ্যটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই দৃশ্যের সঙ্গে শেষ দৃশ্যের গভীর সংযোগ বিদ্যমান। রেহানা বলে, গেইট খুলো। ছাত্র-ছাত্রীরা গেইট খুলে না। বরং পানি ছুঁড়ে মারে রেহানার মুখে। রেহানা ক্রোধে চিৎকার করে উঠে গেইট ধরে ঝাঁকায়।
রেহানাকে অফার দেওয়া হয়, চাকুরিও থাকবে, এই গেইট খোলার ব্যবস্থাও প্রিন্সিপাল করবে, যদি আরেফিনের কমপ্লেনটা রেহানা তুলে নেয়। রেহানা রিজাইন দেয়। কমপ্লেন তুলে নেয় না। একদম শেষদিকে ইমুর স্কুলে একটা শো হয়। যেখানে ইমু অংশ নেয়। প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু সহপাঠির করা কমপ্লেনের কারণে স্কুলের রুলস অনুযায়ী স্কুল থেকে রেহানাকে জানানো হয়, তার মেয়েকে শো শুরু করার পূর্বে স্যরি বলতে হবে। তবেই অংশ নিতে পারবে।ভুল না করেও স্যরি?রেহানা স্কুলে যাওয়ার সিদ্ধান্তই বাদ দেয়। রেহানার ভাই রাগ সমেত শেষদিকে চোখে জল নিয়ে একটা প্রশ্ন করে, এইসব তুমি কার জন্য করতেছো?ইমু দৌড়ে পালাতে চায়। যখন জানতে পারে, মা তাকে শো করতে দেবে না। রেহানা দৌড়ে গিয়ে মেয়েকে ধরে আনে। মেয়েও জেদী। মাকে আঁচড়ে কামড়ে ঘোঁ ধরে বসে থাকে। শো করতে সে যাবেই। মাও জেদী। মেয়েকে রুমের ভেতর আটকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন। ইমু ভেতর থেকে দরজায় বাড়ি দিয়ে চিৎকার করে, দরজা খুলো। ক্ষুব্ধ চিৎকার অর্ধেক গলায় রেখে বাকিটা চট করে শেষ। ইমুর এই চিৎকারের সঙ্গে রেহানার ঐ চিৎকারের আশ্চর্যজনক মিল। দু’জনই দরজায় বাড়ি দিচ্ছে। পুরো সিনেমাজুড়ে রেহানা যে দরজার ওপাশে আটকে ছিল, শেষদিকে মেয়েকেও আটকালো ঐ দরজায়। এই দরজার নাম প্রতিবাদ, আত্মসন্মানবোধ, বিবেক, সততা। মেয়ের চিৎকার আমলে নিলে মেয়েটা বারংবার স্যরি বলতে শিখবে। নিজে দোষ না করেও স্যরি বলতে শিখবে। নিজের মাথা নত রাখতে শিখবে। পুনরায় সেলফ ডিফেন্সের জন্য কাউকে কামড় দেবে না আর। মিথ্যা বলতে শিখবে। নরম হতে শিখবে। প্রতিটা মা-বাবা, কিছুটা না কিছুটা থেকে যায় সন্তানের ভেতর। রেহানা মরিয়ম নূর সিনেমা ইমুর ঐ চিৎকারের সঙ্গেই শেষ। কিন্তু আমি জানি, ইমু বড়ো হতে হতে ঠিকই বুঝে নেবে, এই দরজা বন্ধ থাকার বড্ড দরকার। তবেই সে স্বাধীন। ঐ দিন যদি এই দরজা খুলে যেতো, তবেই ইমু আটকা পড়তো আজীবন।
পুরো সিনেমাজুড়ে এত এতগুলো দৃশ্য আছে, প্রতিটা দৃশ্য নিয়ে দশ বারোটা লাইন লেখা যায়। একটা দৃশ্যে খেয়াল করলাম, আয়েশার সঙ্গে আরেফিন নিয়ে কথা বলার পর রেহানা ওয়াশরুমে এসে উনচল্লিশ বার মুখে পানির ঝাপটা দিয়েছে। উনচল্লিশ বার! এই সোসাইটির সভ্য মুখোশ, অসুস্থ মানসিকতা, ঘৃণ্য স্বভাব চরিত্র, হীন মানুষজনের লেগে থাকা স্পর্শগুলো বারংবার পানির ঝাপটা দিয়ে ধুয়ে ফেলার সেকি চেষ্টা তার। রেহানা মরিয়ম নূর আপনি আপনার পরিবারের সঙ্গে বসে দেখুন। রেহানার স্বভাব-চরিত্র থেকে অল্প একটু হলেও কুড়িয়ে এনে লাগিয়ে দিন সন্তানের গায়ে। এইরকম জেদী, শক্ত, সৎ, প্রচণ্ড সাহসী আর প্রতিবাদী নারী চরিত্র বাংলা সিনেমায় আমার দেখা হয়নি আর। পুরো দেড়ঘন্টার এক হিমধরা শীতল যুদ্ধ। আমি চূড়ান্ত মুগ্ধ।
Movie: Rehana Maryam Noor
Bengali: রেহানা মরিয়ম নূর
Initial release: July 7, 2021
Director: Abdullah Mohammad Saad
Cast: Azmeri Haque Badhon, Kazi Sami Hassan, Afia Jahin Jaima, Afia Tabassum Borno
লিখেছেনঃ Shakhawat Hossen
মুভিটি ফ্রি ডাউনলোড করতে মুভির নামের উপর ক্লিক করুন!
অন্যান্য ব্লগ পড়তে ক্লিক করুন