এক নজরে সিনেমার তথ্য।
Haldaa (2017)
Genren: Drama
IMDB: 8.2
Runtime: 2h 17m
Director: Tauquir Ahmed
Actors: Zahid Hasan, Mosharraf Karim, Nusrat Imroz Tisha, Fazlur Rahman Babu, Runa Khan
বাংলাদেশের অন্যতম সেরা একটি প্রাকৃতিক সম্পদ হালদা নদী৷ এটি দেশের সর্ববৃহৎ প্রাকৃতিক মৎস প্রজন কেন্দ্র। এমনকি সারা পৃথিবীর মধ্যে খুব সামান্য কিছু যায়গা আছ্ব যেখানে প্রাকৃতিক ভাবে মৎস প্রজনন হয়৷ হালদা এর মাঝে অন্যতম।
হালদা মূলত কার্প জাতীয় মাছ যেমন, রুই, কাতলা, মৃগেল ইত্যাদি ধরনের মাছের জন্য প্রসিদ্ধ।
প্রতিবছর হালদা নদীতে একটি বিশেষ মূহুর্তে ও বিশেষ পরিবেশে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউস ও কার্প জাতীয় মাতৃমাছ প্রচুর পরিমাণ ডিম ছাড়ে। ডিম ছাড়ার বিশেষ সময়কে “তিথি” বলা হয়ে থাকে। মা মাছেরা এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত শুধু অমাবস্যা বা পূর্ণিমার তিথিতে অনুকূল পরিবেশে ডিম ছাড়ে। ডিম ছাড়ার এই বিশেষ সময়কে স্থানীয়রা “জো” বলে। এই জো এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অমাবস্যা বা পূর্ণিমা হতে হবে, সেই সাথে প্রচণ্ড বজ্রপাতসহ বৃষ্টিপাত হতে হবে;- এই বৃষ্টিপাত শুধু স্থানীয় ভাবে হলে হবে না, তা নদীর উজানেও হতে হবে। ফলে নদীতে পাহাড়ি ঢলের সৃষ্টি হয়। এতে পানি অত্যন্ত ঘোলা ও খরস্রোতা হয়ে ফেনাকারে প্রবাহিত হয়। জো এর সর্বশেষ বৈশিষ্ট্য হল নদীর জোয়ার-ভাটার জন্য অপেক্ষা করা। পূর্ণ জোয়ারের শেষে অথবা পূর্ণ ভাটার শেষে পানি যখন স্থির হয় তখনই কেবল মা মাছ ডিম ছাড়ে। মা মাছেরা ডিম ছাড়ার আগে পরীক্ষামূলক ভাবে অল্প ডিম ছাড়ে। ডিম ছাড়ার অনুকূল পরিবেশ না পেলে মা মাছ ডিম নিজের দেহের মধ্যে নষ্ট করে দেয়। ডিম সংগ্রহ করে জেলেরা বিভিন্ন বাণিজ্যিক হ্যাচারিতে উচ্চমূল্যে বিক্রি করেন।
একসময় এই নদী থেকে প্রচুর পরিমান মাছের রেনু সংগ্রহ করা হতো। যা দিয়ে নদী পারের হাজারো মানুষের জীবিকা নির্বাহ হতো।
কিন্তু প্রকৃতির গতিপথ রোধ করে নানাবিধ অপকর্ম, নদী দূষণ, সরকারি উদাসীনতা ইত্যাদির মাধ্যমে আজ হালদা মৃত প্রায়।
বর্তমানে নদীদস্যুদের কবলে পড়েছে হালদা। দস্যুদের হাত থেকে হালদাকে মুক্ত করাই নদীপাড়ের মানুষের বড় চ্যালেঞ্জ। সাধারণভাবে বলতে গেলে, হালদাপাড়ের মানুষের জীবনের কথা সিনেমার পর্দায় তুলে ধরেছেন পরিচালক তৌকীর আহমেদ। পরিচালক হালদাকে দেশ হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন। হালদাকে যদি আমরা সুরক্ষা না করতে পারি, তাহলে দেশকে সুরক্ষা করতে পারব না। সিনেমার মূল বক্তব্যই এখানে। নানা প্রতীকীর মাধ্যমে হালদাকে কখনো দেশ বা কখনো নারীর সঙ্গে তুলনা করেছেন পরিচালক তৌকীর আহমেদ। নারীদের যদি রক্ষা না করতে পারি, দেশকে রক্ষা করতে পারব না; আবার নদীকে দস্যুদের হাত থেকে রক্ষা না করতে পারলে দেশকে রক্ষা করা যাবে না।
নানা শ্রেণির মানুষের গল্পের সমন্নয়ে হালদা সিনেমার গল্প এগিয়ে যায়। ছবিতে উচ্চ, নিম্ন ও মধ্য—সব শ্রেণির উপস্থিতি রয়েছে। হালদাতে উচ্চবিত্তের প্রতিনিধি করে নাদের চৌধুরী। সে-ই মূলত হালদাকে জিম্মি করে রাখে। নাদের চৌধুরীর চরিত্র অভিনয় করেন জাহিদ হাসান। তিনি নিজেকে আবারও প্রমাণ করলেন, আমি একজন জাত অভিনেতাই বটে। জাহিদ হাসানকে সিনেমা বা টিভির দর্শকরা ইতিবাচক চরিত্রে দেখতে অভ্যস্ত। কিন্তু হালদা সিনেমায় তাঁর নেতিবাচক অভিনয়েও মুগ্ধ হয়েছেন দর্শক।
ফজলুল রহমান বাবু বরাবর জাঁদরেল অভিনেতা। তবে নিম্নবিত্ত শ্রেণির অভিনয় পেলে নিজেকেই কোনো কোনো সময় ছাপিয়ে ওঠেন তিনি। হালদা সিনেমায় জেলে সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব তিনি করেছেন মনু মিয়া চরিত্র হয়ে। তৌকীর আহমেদের ‘অজ্ঞাতনামা’ সিনেমায় ফজলুল রহমান বাবুর অভিনয়ের কথা সবার মনে আছে। হালদা সিনেমাতেও বাবুকে দর্শক তাঁদের চাহিদামতো অভিনয় পাবেন বলে আশা করছি।
হাসু চরিত্রে অভিনয় করেছে তিশা। সিনেমার চরিত্র হাসুই আসলে হালদা, আবার হালদাই হাসু। প্রতীক অর্থে হাসু আবার দেশও বটে। পরিচালক খুব মুন্সিয়ানার মাধ্যমে এই হাসু চরিত্রকে নদী ও দেশের প্রতীক করে তুলেছে। এ ক্ষেত্রে পরিচালক সফলও বটে। নাদের চৌধুরীর বিবাহিত দ্বিতীয় বউ হাসু। তবে সে নাদেরের কাছে যেমন জিম্মি, তেমনি নাদেরের কাছে জিম্মি হালদা নদী। সিনেমা শেষে হাসু নাদেরের কাছ থেকে মুক্তি পায়। এ মুক্তি হাসু নিজের চেষ্টায় মূলত পায়।
হাসুর মুক্তি পাওয়া পরিচালক হালদা নদীর মুক্তি পাওয়া বুঝিয়েছেন। তিশা নিজের অভিনয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন হালদাতেও। এই সিনেমাতে আরেকজন উল্লেখযোগ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন রুনা খান। তার চরিত্রের নাম জুঁই, নাদের চৌধুরীর প্রথম বউ। একজন সাধারণ নারীর মনে যে সৎ-অসৎ দ্বন্দ্বগুলো বাস করে, তা ফুটিয়ে তুলেছেন সিনেমায় জুঁই চরিত্র।
রুনা খানের অভিনয় দেখে দর্শক বলতে পারবেন না, তাঁর ভূমিকা সঠিক না ভুল ছিল। এই চরিত্রের মাধ্যমে পরিচালক আমাদের অধিকাংশ সাধারণ মানুষের মনের প্রতিচ্ছবি দেখিয়েছেন। একটি মনের দুটি অংশ—ভালো ও মন্দ। এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সফল পরিচালক ও রুনা খান। সিনেমায় নায়কের কথা একটু শেষেই বলি। বদিউজ্জামান ওরফে বদি চরিত্রে নিজেকে মেলে ধরেছেন মোশাররফ করিম। তাঁর অভিনয়ের কথা না-ই বা বললাম। দর্শকরা হলে গিয়ে দেখুক না! এ ছাড়া হালদা সিনেমায় অভিনয় করেছেন মোমেনা চৌধুরী, শাহেদ আলী প্রমুখ।
দুই ঘণ্টা ১৭ মিনিটের মাত্র ২২ দিনে শুটিং করা খুব দুঃসাধ্য কাজ। এ ছাড়া শুটিংস্পটে সাধারণ দর্শকের ভিড় সামলানো কঠিনই বটে।
বেশি তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে পরিচালক তৌকীর আহমেদ জেলেদের বৈচিত্র্যময় জীবনের করুণ মানবিকতাকে খুব স্পর্শকাতর করে দর্শকের সামনে তুলে ধরতে কিছুটা কমতি করেছেন। জেলেদের জীবনের কষ্ট যদি পরিপূর্ণভাবে পর্দায় দেখানো যেত, তাহলে গল্পের ঘাটতি আরো ভালো হতো। যেহেতু হালদা সিনেমাটি সম্পূর্ণ চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায়। তাই সারা দেশের দর্শকের কাছে ভাষা বুঝতে কঠিনতর মনে হতে পারে। তবে শিল্পীদের অভিনয় দেখে অনেকের ভাষা বুঝতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। ছবিতে ইংরেজিতে সাব-টাইটেলও রয়েছে।
শিল্প নির্দেশনা আরো ভালো হয়তো হতে পারত। মনু মিয়া সাধারণ জেলে, তার বাড়ি লোহার জানালায় শিক (গ্রিল) দেখানো যুক্তিযুক্ত হয়েছে কি না, দর্শকরাই ভালো বলতে পারবেন। ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় পরিবেশদূষণ হয়, নদীও পরিবেশের বাইরে নয়। তবে মূল কাহিনী যেহেতু নদীকে কেন্দ্র করে, তাই কোন রাসায়নিক কলকারখানার বর্জ্যের মাধ্যমে নদীদূষণ হচ্ছে তা পরিষ্কারভাবে দেখালে পরিচালকের ত্রুটি থাকত না।
তবে যা-ই হোক, হালদা সিনেমার পরিচালক তৌকীর আহমেদ সফল। এই সিনেমায় একটি মানবিক সংবাদ দিয়েছেন তিনি। দেশ, নদী ও নারী একই বিষয়। কোনোটা থেকে কোনোটা আলাদা কিছু নয়।
এগুলো টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের। হালদাকে পূর্ণ্যদৈর্ঘ্য সিনেমা করে তুলতে বাংলার নানা লোকঐতিহ্য কুস্তি খেলা, নৌকাবাইচ, কবিগান প্রাসঙ্গিকভাবে তুলে এনেছেন হালদার কর্ণধার তৌকীর আহমেদ। সর্বোপরি বলতে পারি দেশ, নদী, নারীর দায়বদ্ধতা থেকে এই সিনেমা। যা সাধারণ মানুষের মনের কথা।