সিনেমার নেশা ধরার পর থেকে দু’হাজার সাত এর পরে দু’হাজার উনিশের মতো অনন্যসুলভ একটি বছরের সাক্ষী হতে পেরেছি। উভয় বছরই মাস্টারপিস সব ফিল্মে করেছে টইটুম্বুর। তবে ২০১৯ সালটা মনে তুলনামূলক বেশি জায়গা দখল করে রাখবে। কেননা বরেণ্য পরিচালক ও সেইসাথে আমার অত্যধিক প্রণয়ভাজন মার্টিন স্কোরস্যাসি পেরেছেন বছরটা দাপিয়ে শাসন করতে। Uncut Gems ও The Souvenir এর মতো বহুল প্রশংসিত ফিল্ম প্রযোজনার কাজ করেছেন, বব ডিলেনকে নিয়ে জবর তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন এবং সর্বোপরি উপহার দিয়েছেন দি আইরিশম্যান নামক মণি।⇲ দি আইরিশম্যানের সারসংক্ষেপ ⇲ট্রাক চালক ফ্র্যাঙ্ক শিরানের পরিচয় হয় মাফিয়া বস রাসল বাফেলিনোর সঙ্গে। দুজনের মধ্যে সখ্যতা গড়ার পর থেকেই শিরান পায় অন্যের জীবন নাশ করার কাজের ভার। আস্থাসহকারে কার্য সম্পাদনের মাধ্যমে ফ্র্যাঙ্ক মাফিয়াতে বেশ নাম কামাই করে ফেলে নিমিষেই। একসময় সে ট্রাক ড্রাইভিং সমিতির সভাপতি জিমি হফারও প্রণয়ের পাত্র বনে যায়। এর অনন্তর সে মাফিয়া ও ইউনিয়ন উভয়ের জন্যই অসাধু কর্ম করতে থাকে। কিন্তু ধীরে ধীরে দু’পক্ষের মধ্যে সংঘাতে ফ্র্যাঙ্কের জীবনে নেমে আসতে থাকে নিষ্প্রভতা।আইরিশম্যান চার্লস ব্র্যান্ডের লিখিত ফ্র্যাঙ্ক শিরানের স্বীকারোক্তিমূলক বই I Heard You Paint Houses অবলম্বনে তৈয়ার করা হয়েছে। স্কোরস্যাসির ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ ব্যাপ্তিকাল ও সবচাইতে বেশি বাজেটসম্পন্ন ফিল্মটি যখন কৃতঘ্ন হলিউড প্রযোজনা করতে অসম্মতি জানায় তখন স্ট্রিমিং সাইট নেটফ্লিক্স বাড়িয়ে দেয় সহায়তার হাত। মার্টি চাইলে তারুণ্যপূর্ণ কাস্ট নিয়ে ফিল্মটি তৈরি করতে পারতেন। কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন বয়স্ক অভিনেতারূপী বিশ্বস্ত বন্ধুদের নিয়ে রুপালি পর্দায় সেই ঘরনার সিনেমা নিয়ে ফিরতে, যেটার জন্য তিনি আজ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। এতে সিনেমার কাহিনী যেহেতু কয়েক যুগ পর্যন্ত বিস্তৃত সেজন্য কুশীলবদের ডিডিটালি পুনর্যৌবন লাভ করানো হয়, যেমনটি এরূপ ধাঁচের চলচ্চিত্রের জন্য আগে কখনো করা হয়নি। প্রযুক্তির ব্যবহারে বুড়ো অভিনেতাদের জোয়ান করার ইফেক্টটি বিশেষ করে দে নিরোর উপর অস্বচ্ছন্দ দেখালেও চরিত্রের বিশদ ব্যাখ্যার লক্ষ্যে এই সামান্য মূল্য চুকানোটা বৃথা যায়নি।গ্যাংস্টার মুভির সম্রাট স্কোরস্যাসি খুব বিরল ডিরেক্টদের একজন যিনি টানা পাঁচ দশক ধরে কমপক্ষে একটি করে মাস্টারপিসের সৃজন ঘটিয়েছেন। ২০১০-এর দশকে তাঁর The Wolf Of Wall Street কিংবা Silence ছিলই, তবে আরও উৎকৃষ্ট শিল্পকর্ম পেশ করলেন আইরিশম্যানের মাধ্যমে। তিনি একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা হবার আগে মূলত একজন সিনেমাপ্রেমী। চাইলেই কেউ তাঁর মতো সিনেমার সাথে এত নিঃস্বার্থ ও নিগূঢ়ভাবে মহব্বত করতে পারে না। তাঁর তৈরি একেকটা চলচ্চিত্র সেই ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ যেগুলো ধারণে যে-কোনো প্রকৃত সিনেমা ভক্ত বাধ্য মাতোয়ারা হতে।। আইরিশম্যান সেই অশেষ ভালোবাসারই নয়াভাবে উপস্থাপনা। সিনেমাটির পূর্বে মার্টি ও দে নিরো শেষ জুটি বেঁধেছিলেন সেই ১৯৯৫ এর ক্যাসিনো ফিল্মে। এই শতাব্দীতে প্রথমবারের মতো এই সর্বশ্রেষ্ঠ সোনালি যুগলের প্রত্যাবর্তন ঘটানোটা সিনেমা পাগলদের জন্য বিশাল সৌভাগ্যের ব্যাপার। সঙ্গে আবার পাচিনো ও পেশির মতো কিংবদন্তি থাকায় এ যেন পুরাই সোনায় সোহাগা! নিরো-পেশি, পেশি-পাচিনো কিংবা পাচিনো-নিরোর দৃশ্যগুলো— যেগুলো তাদের সহজাত সুদক্ষ অভিনয় দিয়ে অলঙ্কৃত— সেগুলো দর্শনের পশ্চাত বহুকাল ক্ষোদিত করা থাকবে স্মৃতিতে।ক্লাসিক স্কোরস্যাসিয়ান গ্যাংস্টার মুভির মতো আইরিশম্যানের গোড়াপত্তনে সেই অপকর্মার গল্পকথন; বিভিন্ন অপরাধীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ; হত্যাসাধন, বেইমানি ও আলাদাতের বিচারকার্যে ঠাসা তেজী প্লট। বরাবরের মতোই তিনি গ্যাংস্টারদের সামাজিক রীতি ও আচরণগত বিধি একেবারে ক্ষুদ্রতম অঙ্গভঙ্গি ও খুঁটিনাটি পর্যন্ত প্রদর্শন করেছেন। রয়েছে তাক লাগানো ট্র্যাকিং শট, চতুর ভয়েসওভার, মধুর রেট্রো মেলডি ও দর্শকদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য হিউমারও। প্রত্যেকটা শট প্রফুল্লিত করা হয়েছে তুলনারহিত, সৌষ্ঠবপূর্ণ ও সাংঘাতিক শৈলী দ্বারা। তাঁর টেকনিকাল পারফেকশন দিয়ে আমাদের তৃপ্ত করা ছাড়েননি আশি ছুঁই ছুঁই বয়সে এসেও! সব মিলিয়ে, দাঙ্গাহাঙ্গামাপূর্ণ সংঘটনে বিস্তারিত বর্ণনায় অতীত বৃত্তান্ত সত্য ঘটনার উল্লেখ করে আইরিশম্যান আঁকে জটিল এক ছবি। পরবর্তীতে আবার আকস্মিকভাবে সিনেমাটিতে জীবনের উপর বিষাদগ্রস্ত আলোকপাত করাতে দেখা যায়, যেটার নজির মেলেনি স্কোরস্যাসির আর কোনো ফিল্মেই। আমি মনে করি থার্ড অ্যাক্টের চিন্তানিমগ্নতা Silence ফিল্মকে ছাড়িয়ে আইরিশম্যানকে পরিণত করেছে তাঁর সবচেয়ে বলবৎ ধ্যারপরায়ণ ফিল্মে। গতিভঙ্গীতে বৈচিত্র্য এনে তখন গ্যাংস্টার পরবর্তী জীবনের দিকে মনোযোগ দেয়া হয়, যাতে বেরিয়ে আসে অকোমল বাস্তবতাগুলোও। উপরন্তু সিনেমাটিতে সকল কিছু ঠাউর করা সুবিবেচিত ও জরাজীর্ণ সেই চরিত্র ফ্যাঙ্ক শিরান স্বয়ং স্কোরস্যাসিকে প্রতিনিধিত্ব করছে বলে প্রতীয়মান হয়, যিনি অসহায় হয়ে নিজের অতিবাহিত দুনিয়ায় কাছের বন্ধু-বান্ধবদের একে একে ভেঙে পড়তে কিংবা বিলীন হয়ে যেতে দেখছেন। ফিল্মটির বেশ কিছু সিক্যুয়েন্সে প্রায়শ্চিত্তবোধ ফুটে উঠলেও সেটার সমাপ্তি ঘটে না শুদ্ধি কিংবা পরিত্রাণে। সিনেমাটি জানান দেয় স্কোরস্যাসি প্রকাশ্যে ঘোষিত ক্যাথলিক যিনি একসময়ে যাজক হতে চেয়েছিলেন। ক্যাথলিক প্রতীকতা দিয়েই তিনি মর্মার্থের খোঁজ লাগানোর চেষ্টা করেন। জিজ্ঞেস করেন কিছু কটমেটে নৈতিক প্রশ্ন যে, সেই মানুষের অনুশোচনার কি কোন দর আছে যার সূর্যোদয়ের মতো পাপকর্ম করা অবধারিত? ভালো জীবনের প্রকৃত অর্থ-ই বা কী? আর কী-ই বা হবে যদি সেই অর্থ অতি বিলম্বে আবিষ্কার করা যায়? শেষে শিরানের রুমের দরজা খোলা রাখতে বলাটা হফার একটা অভ্যাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার সঙ্গে যেন উল্লেখিত প্রশ্নগুলোর টুকরিও উন্মুক্ত রেখে যায় দর্শকদের নিজ নিজ উত্তর দিয়ে পূর্ণ করার জন্য। এই যুগে এসেও এমন ফিল্ম বানিয়ে স্কোরস্যাসি সিনেমার প্রতি ভালোবাসা পুনর্বার জাহির করেছেন, যেই ভালোবাসা প্রেক্ষাগৃহগুলো থেকে বিলুপ্ত হওয়ার পথে, কিন্তু অবশ্যই আজও সবলে বেঁচে আছে আন্তরিক সিনেমা অনুরাগীদের মাঝে। ট্যাক্সি ড্রাইভার কিংবা মিন স্ট্রিট কোন অস্কার জেতেনি; কিং অব কমেডি পায়নি বক্স অফিসে সফলতার দেখা; এসব নগণ্য জিনিসের ঊর্ধ্বে বলেই স্কোরস্যাসির ছবিগুলো আজ সংরক্ষিত সেলুলয়েড জগতের একেকটা অমূল্য সম্পদ হিসেবে। সেদিন আইরিশম্যানকে কোনো অস্কার দেয়া হয়নি ঠিকই, কিন্তু ডলবি থিয়েটারে বসে থাকা সবচেয়ে জ্ঞানবান মানুষটিকে সবার দাঁড়িয়ে সম্মান জানানোটা যে যে-কোনো অ্যাওয়ার্ডের মূল্যকে প্রকাণ্ডভাবে যায় ছাড়িয়ে। আশা করা যায় কয়েক যুগ বাদে আইরিশম্যান স্কোরস্যাসির সব ক্লাসিকগুলোর ন্যায় হয়ে যাবে চির-উজ্জ্বল হীরক।


A bittersweet life (2005) Movie Bangla Review
A bittersweet life (2005) One late autumn night…The disciple woke up and crying. so the master asked did you have a nightmare? The disciple replied